বাংলাদেশ তবে কিসের ভূমিকায়?
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এর মতে "বাংলাদেশ এর উন্নয়ন মানেই ভারতের উন্নয়ন। "(দৈনিক যুগান্তর - ৮ আগস্ট ২০২০)
তো ব্যাপার হচ্ছে, গতবছর এই তিনিই কিন্তু আরেকটা কন্ট্রোভার্সিয়াল বক্তব্য দিয়েছিলেন, যে -- "ভারত বাংলাদেশ এর সম্পর্ক স্বামী স্ত্রী এর মত "(দৈনিক প্রথম আলো - ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) ।
তখন কৌতুহলী জনতার মনে প্রশ্ন ছিলো, তাহলে কে স্বামী আর কে স্ত্রী। এবার তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেছে, কে স্বামী আর কে স্ত্রী!?
আমার কাছে তার বক্তব্য শুনে মনে হলো, বাংলাদেশ হয়ত স্বামীর ভূমিকায় আছে। আর ভারত হচ্ছে স্ত্রী। কেননা, "আমরা যা দিয়েছি সেটা ভারত সারাজীবন মনে রাখবে"। স্বামীর কষ্টে উপার্জিত উপার্জন দিয়ে তার স্ত্রীকে ভরিয়ে দেয় নানা কিছু দিয়ে। যা স্ত্রী সারা জীবন মনে রাখে। স্বামী গাধার খাটুনি খেটে স্ত্রীকে তার উপার্জনের সিংহ ভাগ দিয়ে দেয়। আর নিজের জন্য রাখে নাম মাত্র কিছু। এসব কিছুর মাধ্যমে নিমক হারাম স্ত্রী ভক্ত স্বামী নিজের পিতা-মাতার কথা ভুলে যায়। হয়তোবা কিছু দেয়, সেটা হয় নাম মাত্র।
ঐ এত সব কথার মানে একটাই। ভারত হচ্ছে বাংলাদেশের স্ত্রী। কথিত এই ব্যাপারটা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা যেতে পারে। চলুন আগে বারি ---
নিজের দেশে বেকারের হার ভয়ানক ভাবে বাড়ছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। সেই বেকারত্বের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ৪ লাখ ভারতীয়কে অবৈধ ভাবে বাংলাদেশে কাজের সুযোগ দেয়া হলো। বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরকে ভারতের জন্য নাম মাত্র মূল্যে করিডর হিসেবে ব্যাবহার করতে দেয়া হলো। এছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যাপারে ভারতের কন্ট্রোল তো আছেই। অনেক বিতর্কিত ব্যাপারও লক্ষ্য করা যায়। যেমন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাঝে ভারতীয় বিভিন্ন এজেন্সির অস্ত্র সরবরাহ, যাতে সরকারের নীরব আচরণ, অবাধে সীমান্ত হত্যা। যাতে সরকার দর্শক এর ভূমিকায়। চীন ব্যাতিত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তি গুলোও ভারতের কথা ভেবে করা। এসব কিছু কি বুঝায়?
আচ্ছা, অন্য সব ব্যাপার বাদ দিলাম। দেশে বেকারত্বের সরকারি হিসেব মতে ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এটা বিবিএস এর হিসাব। এই হিসেবটা কিন্তু আসলে অথেনটিক না। মূলত অথেনটিক ধরা হয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা (আইএলও) এর হিসেব। যার মতে বাংলাদেশে ৩ কোটিরও বেশি বেকার আছে। (দৈনিক ইনকিলাব - ১৫ ফেব্রুঃ ২০১৯)। আইএলও এর হিসেবেকে বিশ্বের প্রতিটি দেশই শুদ্ধ হিসেবে ধরে থাকে। একটি বিশাল জনগোষ্ঠী বেকার থাকার পরেও তাদের সুযোগ না দিয়ে ভারতের ৪ লাখ মানুষকে অবৈধ কর্মসংস্থানের সুযোগ দেয়াটাকে কি বুঝায়? আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়সে ভেলের ‘বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ভারতীয়দের দাপট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় বিভিন্ন খাতে চাকরি করছেন। এদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশের ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে। বেশিরভাগই আসেন ট্যুরিস্ট ভিসায়। অর্থাৎ সাড়ে ৪ লাখ ভারতীয় বাংলাদেশে অবৈধভাবে কাজ করছেন। এদের বেতন ডলারে ভারতেই পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাহ! কি বুঝলেন? এ যেন এক অন্যরকম নারীর টান। দেশ কি অবস্থানে আছে সেটা মুখ্য না। মুখ্য স্ত্রী ভারতকে খুশি করতে হবে।
স্ত্রী পাগল স্বামীর সন্তানেরা যখন স্ত্রী, মানে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলে তখন স্বামীর মাথা গরম হয়ে যায়। রাগের মাথায় মেধাবী সন্তানের প্রাণ নিয়ে নেয়। সহযোগী হিসেবে থাকে ভারতের সংগঠন ইস্কন। তার একটি উদাহরণ হলো শহীদ আবরার।
যাক, স্বামী স্ত্রী এর ব্যাপারটা এতক্ষন রুপক অর্থে বলেছি। আসলে বর্তমানে সরকারের ভারতের প্রতি নতজানু মনোভাবের জন্য যেসব চুক্তি হয়েছে এ পর্যন্ত, তাতে করে বাংলাদেশের যা ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে তা পুষিয়ে নিতে কয়েক যুগ লেগে যাবে। শুধু বন্দরের চুক্তির কথা ভাবুন, নাম মাত্র মূল্যে তারা ট্রানজিট সুবিধা নিচ্ছে। বলতে গেলে তারা আমাদের বন্দর কে করিডর হিসেবেই ব্যাবহার করবে। আর আমরা দেশের জনগণের চুপ করে দেখা ছাড়া আর উপায়ও নেই। ভারত-বাংলাদেশ এর সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ, তাহলে সীনান্তে কেন উত্তেজনা? পানি বন্টনে কেন এত গড়িমসি? ভারতীয় সাম্প্রদায়িক গণমাধ্যম গুলোতে বাংলাদেশ নিয়ে কেন এত মিথ্যাচার? কেন এত কটাক্ষ? আমার বুঝে আসেনা। বাংলাদেশ ও ভারতের চলতি সম্পর্ক কেমন সেটা আমরা বুঝতে পারি বাণিজ্যিক অসাম্য দেখে। আমরা ভারতে খুব সামান্যই রপ্তানি করি, বড়জোর ৬০০ বা ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের মতো পণ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানির পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এই অসাম্য দূর করা নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে অনেক সময় অনেক কথা শোনা গেছে, শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানির দাবিও জানানো হয়েছে। কোনো কাজ হয়নি, বরং উল্টো বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে ভারত। গত বছর ঢাকায় আয়োজিত এক সেমিনারে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে রপ্তানি করে এমন অনেক পণ্য রয়েছে, যা ভারত বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করলেও বাংলাদেশ থেকে করে না। অব্যাহত অসমান্তরাল বাণিজ্যের ফলে বাংলাদেশের বাজার ভারতীয় পণ্যে সয়লাব। অথচ আমরা?
এবার আসুন শিল্প-সংস্কৃতির খাত। ভারতের বাংলা ভাষাভাষী দের সাথে আমাদের শিল্প সংস্কৃতির মিল আছে। তাদের প্রচার করা নাটক সিনেমা আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। তাদের চ্যানেল গুলো আমাদের দেশের টিয়ারপি ব্যাবহার করে যতটা লাভ করে, আমাদের দেশের কোন চ্যানেলই সেই সুযোগ পায় না। পায়না বলতে দেয়া হয় না। এত সব কিছুর পর আমরা বলবো, ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র!
যতদিন না নতজানু পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ বন্ধ হচ্ছে, ততদিন আসলে আমরা ভারত দ্বারা শোষিত হয়েই যাবো। আমরা কতটা নতজানু সেটা সীমান্ত দেখলেই বুঝা যায়! পাখির মতো গুলি করা হয় সীমান্তে। কারনে অকারণে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয় সীমান্তে কিন্তু উপরের মহল থেকে কোন প্রতিবাদ করা হয় না। অথচ ২০১৮ সালে নেপালের সীমান্তে এক কিশোর গুলিবিদ্ধ হওয়ার প্রতিবাদে নেপালীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে পড়ে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল করজোড়ে ক্ষমা চেয়েছিলো। আর বাংলাদেশের সীমান্ত হত্যা নিয়ে নেতাকর্মীদের বক্তব্য আমাদের হতবাক করে।
আর বাংলাদেশের ব্যাপারটা কেমন? ফেলানি হত্যার পর চুক্তি হয়েছিলো বাংলাদেশ সীমান্তে আর গুলি চলবে না। কিন্তু গুলি চলেছে। শত শত বাংলাদেশি হত্যা হয়েছে।
একটা ব্যাপার কি,
ভারত বাংলাদেশকে নিজেদের স্বার্থে ব্যাবহার করছে। নিজেদের প্রয়োজন মত পন্য সমূহ দেশে ঢুকাচ্ছে আর যা দরকার নেই সেটা বন্ধ করে দিচ্ছে। দেশের শিল্প-অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভারতের অবাধ নিয়ন্ত্রণ। সব কিছু আলোচনায় বলা যাবে না। আর যা বলেছি, তাতেও ভয় করছে। গণতান্ত্রিক দেশে বাকস্বাধীনতায় বহু নিষেধাজ্ঞা। এরপরও বলেদিলাম। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
সবশেষে একটা কথাই বলবো। আমরা তখনই ভারতের আগ্রাসন থেকে মুক্তি পাবো, যখন ভারতের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবকে আমরা তেমন আর তোয়াক্কা করবো না। আমরা হবো স্বনির্ভর। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি সব জায়গায় থাকবে একচ্ছত্র বাংলাদেশেরই আধিপত্য। এসব করতে গেলে আমাদের দরকার একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি, গণতান্ত্রিক মনমানসিকতা সম্পন্ন জনগণ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, একরোখা দেশ প্রেমী রাজনৈতিক দল, যারা কিছু করলে সেটা দেশের স্বার্থের জন্যই করবে। এই সবের একটিও আমাদের নেই। আমরা মনে করি শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামিলীগ ই শুধু ভারতের প্রতি নতজানু, যা একদমই নয়। বিএনপিও কিন্তু একই পথের পথিক।
কাজেই, আমরা যতই ভারত বিরোধী আচরণ করি না কেন, আগে নিজেদের ভিত শক্ত করতে হবে। নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়, যেগুলোর মাধ্যমে আমরা সম্পূর্ণ ভাবে ভারতের উপর নির্ভরশীলতা পরিহার করতে পারবো, তাদের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের বিরোধিতা করতে পারবো, সে গুলো আগে অর্জন করতে হবে। আর এজন্য অনেক কিছুর সংশোধন ও জরুরি।
Comments
Post a Comment