দুনিয়া সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ কি করছিলেন? আর এই প্রশ্ন করা কি জায়েজ?
শুরু করার আগে বলেনেই, যেহেতু এটা ইসলামিক গবেষণামূলক লেখা সেহেতু এটা একটু বড় হতে পারে। ধৈর্য নিয়ে পড়ার অনুরোধ রইলো।
আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন আসে, এই দুনিয়া সৃষ্টির আগে আল্লাহ কি করেছিলেন? নাস্তিকরা তো এই প্রশ্ন করে একবারে আকাশে ভাসে। কারন আমার আপনার মতো সাধারণ মুসলিম কোনদিনও এটার উত্তর দিতে পারবে না। অতঃপর তাদের পাল্লা ভারি হবার সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায়। কিন্তু, একবার যদি গভীর ভাবে এটা নিয়ে ভাবুন, উত্তর পেয়ে যাবেন। কারন স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন - “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই যিনি তাঁর দাসের প্রতি এই কিতাব (আল কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন এবং এতে তিনি অসঙ্গতি রাখেননি।” - (আল কুরআন, সুরা কাহফ ১৮ : ১)।
এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে.....
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন -- "বলুন - তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করবে যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দুই দিনে আর তোমরা তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে চাও? তিনি তো জগতসমূহের প্রভু। তিনি ভূপৃষ্ঠে অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন এবং তাতে রেখেছেন কল্যাণ এবং চার দিনে ব্যবস্থা করেছেন খাদ্যের - যাঞ্চাকারীদের জন্য সমভাবে। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যা ছিল ধূম্রপুঞ্জ বিশেষ। অতঃপর তিনি ওটাকে এবং পৃথিবীকে বললেনঃ তোমরা উভয়ে এসো স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বললঃ আমরা এলাম অনুগত হয়ে।” (আল কোরআন, হা-মিম সিজদাহ ৯-১১)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন মাত্র ২ দিনে। আর পৃথিবী সুবিন্যাসের পর তিনি আকাশ এর দিকে মন দিলেন। (সুরা বাকারাহ)।
তাহলে আমরা দেখতে পারছি আগে সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবী তারপর আকাশ। কিন্তু বিজ্ঞান কি বলে? বিজ্ঞান বলে আকাশ পৃথিবীর চেয়ে পুরোনো। এটা নিয়েই বিশদ ভাবে বলছি।
এই বিশ্ব জাহান সৃষ্টির ব্যাপারে বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করেছে বিগব্যাং থিওরি দিয়ে। এই থিওরি অনেক আগে ফিজিক্সে পড়েছিলাম। যদিও আমি ফিজিক্স/ম্যাথে কাঁচা। এরপরেও হাল্কা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি দিচ্ছি কোরআনের রেফারেন্স।
আজ থেকে প্রায় তেরোশো কোটি বছর আগে মহাকাশের বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সিপুঞ্জ, আর তার ভেতরের সকল নক্ষত্র, গ্রহ-উপগ্রহসহ সমস্ত মহাবিশ্বটি নিহিত ছিলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি বিন্দুতে! যার ভর ছিলো পুরো মহাবিশ্বের ভরের সমান এবং ঘনত্ব ছিলো অসীম! আরেকটু বুঝিয়ে বলি। ধরুণ, এই পুরো পৃথিবীটাকে যদি কোনভাবে চেপে-টেপে ঘনীভূত করে একটা ক্রিকেট বল বানিয়ে ফেলেন, তাহলে অবস্থাটা কিরকম দাঁড়াবে একবার কল্পনা করুন। সেই ক্রিকেট বলের বস্তুর পরিমাণ হবে পুরো পৃথিবীর বস্তুর পরিমাণের সমান। পুরো পৃথিবীকে এভাবে বলের ভেতর এঁটে ফেলার জন্য তার ঘনত্ব হবে অকল্পনীয়! তাহলে এবার ভাবুন- এই পৃথিবী, তার চাঁদ, পৃথিবীর চাইতেও তেরোলক্ষগুণ বড় আকৃতির ওই সূর্যটা, পুরো সৌরজগত, সূর্যের মত লক্ষ কোটি নক্ষত্র, নক্ষত্রদের ধারণ করা বিশ হাজার কোটি গ্যালাক্সিসহ সবকিছু একীভূত ছিলো হাইড্রোজেন পরমাণুর চাইতেও ছোট একটি বিন্দুতে। সত্যিই ভাবতে পারা যায় না, তাই না? এই বিন্দুকে বিজ্ঞানীরা সাধারণভাবে ডেকে থাকেন ‘Singularity’ । এই সিঙ্গুলারিটির ঘনত্ব এবং তাপমাত্রা এই দুইটাই ছিলো ইনফিনিটি। ঠিক সেই সময়টুকু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সিঙ্গুলারিটির ভেতরে যা কিছু ঘটেছিলো, সেটিই নির্ধারন করেছে আমাদের আজকের এই মহাবিশ্বটি কেমন হবে। সেই ক্ষুদ্র বিন্দুটির মহাবিস্ফোরণের ফলে ভেতরের সবটুকু পদার্থ প্রচন্ড গতীতে বেরিয়ে মহাবিশ্ব দ্রুত সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। সৃষ্টি হয় আজকের মহাবিশ্ব।
আর পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা'আলা বলেন,“সত্য প্রত্যাখানকারীরা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমন্ডলি ও পৃথিবী মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে; অত:পর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম” (সুরা আম্বিয়া/৩০)
হাদিসে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ব্যাখ্যা করেন, মহান আল্লাহ তা’আলা প্রথমে বিস্তৃত না করা অবস্থায় পৃথিবীকে সৃষ্টি করেন। এরপরে তিনি আকাশ সৃষ্টি করেন এবং ২ দিনে একে ৭ আকাশে পরিনত করেন।
এরপর তিনি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেন এবং এতে পাহাড়, নদী এবং অন্যান্য জিনিস সৃষ্টি করেন। এর আগে পৃথিবী উত্তপ্ত ছিলো। বিগব্যাং এর পর পৃথিবী মানুষের বসবাসের যোগ্য ছিলো না। এছাড়া পবিত্র কোরআনের সুরা নাযিয়াতের দুটি আয়াত পর্যায় ক্রমে দেখলে তা আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ সুরা নাযিয়াতে বলেন - “তোমাদেরকে সৃষ্টি করা অধিক কঠিন, নাকি আকাশ সৃষ্টি? তিনিই [আল্লাহ] তা বানিয়েছেন।” (আল কুরআন, সুরা নাযিআত /২৭)
এরপরে আল্লাহ বলেছেন “এবং পৃথিবীকে এরপরে বিস্তৃত করেছেন।” (আল কুরআন, নাযিআত/৩০)
স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে আকাশমন্ডলী বিন্যাসের পর তিনি পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। গাণিতিক ভাবে পবিত্র কোরআনকে বিশ্লেষণ করলে দুটি আয়াতের সাহায্য নেয়া যেতে পারে, প্রথমত সুরা হামীম সাজদাহর ৯-১১ নং আয়াত। আর দ্বিতীয়ত সুরা আরাফের ৫৪ নং আয়াত। আল্লাহ পৃথিবী ও আকাশ মন্ডলী যথক্রমে ৬ ও ২ দিনে সৃষ্টি করেছেন। ৬/২=৩। অর্থাৎ আকাশ বা মহাশূন্য পৃথিবীর ৩ গুণ পুরনো। বিজ্ঞান বলে ১৩শ কোটি বছর আগে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে আর আমাদের এই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে ৪.৫ কোটি বছর আগে।
এবার আসুন এর আগে তিনি কি করছিলেন। দেখুন, ব্যাপারটা দুনিয়াবি সময় দিয়ে ব্যাখ্যা করলে ভুল হবে। নাস্তিকরা দুনিয়ার বিষয় গুলোর সাথে আল্লাহর তুলনা করে। অথচ, তিনি হলেন সৃষ্টিকর্তা। দুনিয়ায় যা কিছু হচ্ছে বা হবে, এগুলো তিনিই সৃষ্টি করেছেন। স্রষ্টার সাথে কি সৃষ্টির তুলনা হয়?
তো, ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে হলে আমাদের সময় ও গতি সম্পর্কে জানতে হবে। ধরুন ঢাকা হতে চট্টগ্রাম বাসে যেতে সময় লাগে ৭ ঘন্টা। আর বিমানে যেতে লাগে ৩০ মিনিট এর মত। তাহলে সময় ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন। ধরুন আলোর গতী দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবেন। সেক্ষেত্রে আপনার সময় লাগবে শূন্য। কারন আলোর গতিতে ১ সেকেন্ডেরও কম সময়ে ১১ কিমি যাওয়া যায়। এর সাথে পদার্থ বিজ্ঞানের ডায়মেনশনের ব্যাপারটা ওতোপ্রোতো ভাবে জরিত। পদার্থ বিজ্ঞানে বলা আছে 10th dimension achieve করতে পারলে অদৃশ্য দেখা সম্ভব। তার মানে এর আগেও কিছু ছিলো। আর এই সব আমাদের দুনিয়ার জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। অতএব দুনিয়াবি বিষয়ের সাথে আল্লাহকে তুলনা করা উচিত হবে না। কারন, সময় ব্যাপারটা আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর জন্য। যখন পৃথিবীই ছিলো না, তখন সময় ছিলো কি? না। পৃথিবীর এই বিষয়ের সাথে আল্লাহর তুলনা হয় না। কারন এটা তিনিই সৃষ্টি করেছেন। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এসব দুনিয়াবি ব্যাপার দুনিয়ার জন্য আল্লাহর সৃষ্টি। অতএব আল্লাহর জন্য পূর্ব আর বর্তমান বলতে কিছু নেই। এটা দুনিয়ার জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন।
আর নাস্তিকদের সাথে তর্ক করার দরকার নেই। কারন, পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন - "এটা সেই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই। যা মুত্তাকী দের জন্য পথপ্রদর্শক। " (সুরা বাকারা / ১-২) নাস্তিকরা তো আর মুত্তাকী নয়। আর যারা মুত্তাকী না, তাদের জন্য এটা পথপ্রদর্শক হলেও পরে তাদের কাছে হতে পারে না।
আর এটা জায়েজ হবে কি না প্রশ্নের উত্তর -
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
"তোমরা সব কিছু নিয়ে গবেষণা কর। কিন্তু আল্লাহর সত্ত্বা নিয়ে গবেষণা করো না।"
এছাড়াও পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেন,
"তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট,সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে,তারা অনুসরণ করে ফিৎনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশে তন্মধ্যেকার রূপকগুলোর। আর সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর,তারা বলেনঃ আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি। এই সবই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। আর বোধশক্তি সম্পন্নেরা ছাড়া অপর কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।" {সূরা আলে ইমরান-৭}
কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা অনুপাতে আল্লাহর জাত ও সত্ত্বা বিষয়ে অহেতুক গবেষণায় লিপ্ত হওয়া অনর্থক কাজ ছাড়া আর কিছু নয়। আর এই বিষয়েও গবেষণা করা নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। কেননা, তিনি ছাড়া আর কেউই অনেক বিষয়েই অবগত নয়। এটাও একমাত্র তিনিই জানেন। আর তাই, এই বিষয়ে গবেষণা না করাই ভালো।
-- তারেক অরণ্য।

Comments
Post a Comment