ধর্ষণ - এর প্রতিকার কি?
সম্প্রতি দেশে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার প্রশ্নে সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন ছুড়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। মন্ত্রী সারা বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখার কথা বলেছেন। প্রশ্ন রেখেছেন, কোন জায়গায় ধর্ষণ নেই? এমন কোনো দেশ নেই ধর্ষণ হয় না! (যুগান্তর - ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই প্রশ্নটা কেন করেছেন সেটা জানি না। শুধু এইটুকুই জানি ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার প্রশ্নে উনি পাল্টা সাংবাদিকদের এই প্রশ্ন করেছেন। এখন এই প্রশ্নের মাধ্যমে ধর্ষকদের ধিক্কার জানানো হয়েছে না ধর্ষন বেড়ে যাওয়ার প্রশ্নে উনি বিরক্ত হয়েছেন তা আমার বোধগম্য নয়। আবার দেশের বর্তমান দুর্বল আইনের পক্ষে সাফাই গাওয়ার লক্ষেও বলেছেন কি না জানি না। কিছু একটা হবে হয়তো। সেটা আমাদের কারোর কাছেই পরিষ্কার না। তবে তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে ধর্ষকদের বিচার হবে।
যাই হোক......
কথা বলছিলাম ধর্ষণ নিয়ে। আসলে এই বিষয়টা নিয়ে বলে লাভ হবে না জানি, কিন্তু সিলেটের গৃহবধুর উপর ঘটে যাওয়া ঐ নৃশংস ঘটনার পর আসলে না লিখে পারলাম না। দেশের আজ কি হাল ভাবুন! মানুষ কত অসহায়! স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ! আহ! কি নৃশংস! কি জঘন্য! এরকম জঘন্য ঘটনা ঘটে দেশে ধর্ষণের বিচার না হওয়ার জন্য। সুবিচার প্রতিষ্ঠা না হওয়ার জন্য। পুলিশ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী দেশে ধর্ষণ মামলা বিচারের জন্য অপেক্ষমান প্রায় দেড়লক্ষের উপর। এর মাঝে বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩.৬৬ শতাংস। আর বিচার হচ্ছে মাত্র ০.৪% এর। আবার এই বিচারের মাঝেও রয়েছে গাফিলতি! পুলিশের গাফিলতি, রাজনৈতিক ক্ষমতা সাক্ষ্য আইনের ত্রুটিবিচ্যুতি, ফরেনসিক প্রমাণ সংগ্রহে দুর্বলতা, বাদীর আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতা দীর্ঘদিনের সমস্যা। আরো বহু সমস্যা আছে। সব কিছু কাটিয়ে উঠে যদি কঠোর শাস্তির বিধান করা যেত, তবেই হয়তো ধর্ষন রোধ সম্ভব হতো। কিন্তু সেটা কি হয়? দেশে এযাবৎ কালে কয়টা ধর্ষনের বিচার হয়েছে বলতে পারবেন?
২০১৯ সালে দেশে ১,৪১৩ জন নারী ধর্ষনের শিকার হয়েছিলেন। আর ২০১৮ সালে সেটা ছিলো ৭৩২ জনে। (কালের কন্ঠ - ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। ২০২০ সালে ৬ মাসে ধর্ষণ হয়েছে ৬০১ জনের। এর মাঝে ৪৩ জনের বয়স ৬ বছরের কাছাকাছি, ১০৩ জনের বয়স ১২ বছরের কাছাকাছি, ধর্ষণের পর হত্যা হয়েছে ৩৭ জনের। (কালের কন্ঠ - ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০)। বিচার হয়েছে কয় জনের? উত্তরটা আমার জানা নেই!
অনেকেই নারীর পোষাককে ধর্ষণের কারন হিসেবে উল্লেখ করেন। তাহলে এবছর ৬০১ জনের মাঝে যে ৪৩ জন ধর্ষিতা হয়েছেন তাদের প্রত্যেকেরই বয়স ৬ বা তার কাছাকাছি। তো তারাও কি পোষাকের জন্য ধর্ষিতা হয়েছেন? মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন তারই মাদ্রাসার অধ্যক্ষের কাছে। নুসরাত তো মাদ্রাসার ছাত্রী, পর্দাশীল ছিলেন। তিনিও কেন এই লুলুপ আচরণের শিকার হলেন? তাও আবার মাদ্রাসারই শিক্ষক মানে তার প্রিন্সিপালের কাছে! এই ধর্ষণের মূল কারন কি জানেন? আমাদের সমাজ ব্যাবস্থা। আমাদের সমাজ ব্যাবস্থা আমাদের নৈতিক অবক্ষয় এর মূল কারন। আরো একটা ব্যাপার হচ্ছে বিচারহীনতা। দেশে ধর্ষণের শুধু নামমাত্র বিচার হয়। আবার অনেক সময় তাও হয় না।
বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ নারীর ১০ জন ধর্ষিত হয়। বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের কারনে মৃত্যু না হলে মৃত্যুদন্ডের বিধান নেই। সর্বৌচ্চ অর্থ দন্ড নয়তো যাবজ্জীবন। আবার অনেক ক্ষেত্রে ফরেনসিক রিপোর্ট সংগ্রহে গরিমসিও বিচার না হওয়ার একটি কারন। ধর্ষণের ৭২ ঘন্টার মাঝে ফরেনসিক রিপোর্ট সংগ্রহ করলে সঠিক আলামত পাওয়া যায়। এর চেয়ে দেরি হলে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের দেশে ধর্ষণের আলামত সংগ্রহে ৭২ ঘন্টারও বেশি কাল ক্ষেপন করা হয়। ফলে ধর্ষণের আলামত সংগ্রহ কঠিন হয়ে যায়। ফলে বিচারের রায়ও সেরকমই হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিচারই হয় না।
বাংলাদেশের আরো জঘণ্যতম ব্যাপার হচ্ছে বিচারিক কাজে ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে গবেষনা। সত্যি বলতে আমার কাছে এটা হচ্ছে সবচেয়ে জঘন্যতম বিষয় মনে হয়েছে। নারীকে জেরা করার নামে তার চরিত্রে যে কালিমালেপন করা হয়, তাতে সেই ভিকটিম পরিবারের বিচারের দাবি চাওয়ার ইচ্ছাই নষ্ট হয়ে যায়।আমাদের দেশে ধর্ষিতাকে প্রমাণ করতে হয় যে সে ধর্ষিতা। আদালত প্রঙ্গনে বিবরণ দিতে হয় ধর্ষণের। সে কি এক অবস্থা! আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও সেম কাজ হতো। কিন্তু সম্প্রতি তাদের সংবিধানের ১৫৫(৪) ধারা বিলুপ্ত করা হয়েছে। ফলে সে দেশে ধর্ষিতাকে বিচারিক কাজে নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা হয় না। বাংলাদেশে ধর্ষিতা নারীর চারিত্রিক সার্টিফিকেট দেয়ার যে প্রবনতা, এই প্রবনতা সমাজের বিচারিক কাজে দারুন প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশের নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালে বলা আছে ১৮০ দিনের মাঝে বিচার শেষ করতে হবে । বিশেষ ক্ষেত্রে সময় বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে বিচারিক কাজ সম্পন্ন করতে ১০-১২ বছরও লেগে যায়। এই ধীর গতীর জন্য ভিকটিমের পরিবার আত্মসম্মান বোধ থেকে আর বিচার কার্য চলমান রাখতে চায় না।
এই ধর্ষণ রোধ করতে হলে ধর্ষকের বিচার হতে হবে। আমি আবারো বললাম ধর্ষকের বিচার হতে হবে। ধর্ষণের বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দল - মত নির্বিশেষে বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইনের সুষ্ঠূ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। কঠোর আইন প্রনয়ন করতে হবে। আবার শুধু কঠোর আইন প্রণয়ন করেই ধর্ষণ প্রতিরোধ করা যাবে না। ধর্ষণবিরোধী নতুন আইন তৈরির সময় এ ধরনের মামলার বিচারের ক্ষেত্রে প্রধান সীমাবদ্ধতা গুলো নিরসন করতে হবে। বর্তমানে দেখা যায় ধর্ষণবিরোধী আমাদের প্রচলিত আইন পরোক্ষভাবে ধর্ষকদের পক্ষেই অবস্থান নেয়। আমাদের আইনে ধর্ষিতাকেই আদালতে প্রমাণ করতে হয় যে সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভিকটিম বারবার ধর্ষণের বিবরণ ও প্রমাণ উপস্থাপন করতে গিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতার কারনে মানুষিক ভাবে কি যে একটা ভয়ানক অবস্থার সম্মুখীন হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ধর্ষণের মতো অপরাধের সাক্ষী ধর্ষিতার পক্ষে জোগাড় করা কী মর্মান্তিক। সেটা ভাবতেই নিজের কাছে খারাপ লাগে। নতুন আইন প্রণয়নের সময় ধর্ষণ মামলায় প্রমাণের দায়িত্ব ধর্ষকের ওপর অর্পণ করতে হবে। ধর্ষককে বলা হবে সে প্রমাণ করুক যে সে ধর্ষণ করেনি। আইনজীবীর জেরার মুখে তার অপকীর্তি বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে তখন।
লেখা শেষ করার আগে আবারো বলি, ধর্ষণ রোধ করতে হলে ধর্ষণকারীর বিচার করতে হবে। দ্রুত বিচার করে শাস্তির বিধান করতে হবে। গরিমসি করা চলবে না।
প্রত্যেকটা ধর্ষকের বিচার হোক! কঠোর বিচার!
লেখাঃ তারেক অরণ্য।
Comments
Post a Comment